সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পাগলা ঘোড়া তাবৎ দুনিয়া দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে বেদম গতিতে। এর লাগাম টেনে ধরার বা একে থামানোর আপাতত বৈষয়িক কোনো শক্তি আছে বলে মনে হয় না। অবস্থা এই দাড়িয়েছে যে, সুদী লোন ছাড়া বড় মাপের কোনো কিছু করার কল্পনাই করা যায় না। ফলে অভিশপ্ত এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সকল মানুষের জীবন।
এর মধ্যে হাজির হয়েছে ‘মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণের আপদ’ অর্থাৎ ব্যাংকগুলো তো সাধারণত মোটা অংকের সুদী লোন বিত্তবানদেরকেই দিয়ে থাকে। দরিদ্র জনগোষ্টি ও ছোটখাটো উদ্যোক্তা বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের মানুষ প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। এতে করে দরিদ্র জনগোষ্টি ও ছোটখাটো উদ্যোক্তাদের কিছু একটা করার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। তাই দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্টি ও স্বল্প পরিসরে উদ্যোক্তারাও যেন কোনো কিছু করতে পারে সে লক্ষ্যেই হাজির করা হয়েছে মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ ভাবনার রঙ্গিন ফানুস।
এ ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে সেই অভিশপ্ত সুদকেই। অভাবগ্রস্থ মানুষের অভাবকে কাজে লাগিয়ে চড়া সুদে কড়া শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঝুকিমুক্ত লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ক্ষদ্রঋণ। এ জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক। এরপর বেঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠে আশা, ব্র্যাক ইত্যাদি নামের ক্ষুদ্রঋণের নামে সুদী লোন বিতরণকারী অনেক সমিতি বা প্রতিষ্ঠান। যেগুলো এ দেশে এনজিও নামেই সমধিক পরিচিত।
- ইত্যবসরে ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ উদ্যোগ ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে পেয়ে যায় বিশ্বনন্দিত পুরুষ্কার ‘নোবেল পুরুষ্কার’। বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত এ পুরুষ্কার তার ক্ষুদ্রঋণ ভাবনাকে এনে দিয়েছে জগতজোড়া খ্যাতি ও পরিচিতি। হৈচৈ পড়ে যায় সারা বিশ্বে। বিশেষ করে আমাদের এ দেশে। ভাবনার দুয়ার খোলে যায় সারা দুনিয়ার তাবৎ অর্থনীতিবিদদের। নতুন করে ভাবতে শুরু করেন বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগণ। বন্দনায় নেমে পড়েন বিরোধীরাও।
তার এ আবিষ্কার উম্মার জন্য ‘গোদের উপর বিষফোড়া’ হয়ে দেখা দেয়। ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে সুদের কালো থাবা বিত্তবান ও শহরের সীমানা প্রাচীর টপকিয়ে গরীব-অসহায় ও গ্রামীণ জনপদের উঠানেও হানা দেয় বজ্র গতিতে। ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র বিমোচনের মনকাড়া ও চটকদার শ্লোগানের আড়ালে চড়া সুদের নষ্ট জাল ছড়িয়ে দেয় গ্রামীণ জনপদগুলোতে।
সে জালে পা দিয়ে সাবলম্বী হয়েছে এমন লোকের অস্তিত্ব আছে কি না তা বলা মুশকিল। আর সর্বশান্ত হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা অসংখ্য। ডেনমার্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক টম হাইনেমান কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ নামক প্রামণ্য চিত্রের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্রবিমোচনে পুরোপুরি ব্যর্থ। দারিদ্রবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্রবিমোচনে কোনো ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্রবিমোচন সম্ভব নয়।’
দেশের দুর্যোগপ্রবণ ৮ জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনাগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় জরিপ চালানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ঊট) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এ জরিপের প্রতিবেদনে ‘দারিদ্রবিমোচনে দরিদ্র ব্যক্তিদের সম্পদ প্রদানে’র উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
- প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্ত শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবদ খরচ করে ও ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান ও জরুরি সঙ্কট মুকাবিলায়।’
‘হতদরিদ্রদের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ। এছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্র্যাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে আর মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে।’
বিশিষ্টি কবি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্রবিমোচন করে না: বরং সামন্ত সমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে গ্রামীণ ব্যাংক একধরণের ঋণদাসে পরিণত করেছে। দারিদ্রবিমোচনের এ পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চ হারে সুদ নিয়ে কিভাবে গরিবী মোচন হবে? এই অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা সদলবলে লালন করে আসছি।’
0 Comments