ট্রান্সজেন্ডারবাদ এক অপসংস্কৃতির অধ্যায় ( পর্ব-০১)


ট্রান্সজেন্ডারবাদ কী

ট্রান্স মানে পরিবর্তন বা রূপান্তর, জেন্ডার মানে লিঙ্গ। ট্রান্সজেন্ডারের শাব্দিক অর্থ লিঙ্গ পরিবর্তন বা রূপান্তর। পরিভাষায় ট্রান্সজেন্ডার হলো, যারা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করেও কেবল খেয়াল-খুশির বশে বিপরীত লিঙ্গের মতো হতে চায়। অনেকে নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার দাবি করে সার্জারি বা হরমোন ট্রিটমেন্ট করে নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে । তবে এই মতবাদ অনুযায়ী সার্জারি না করে শুধু মুখে নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের দাবি করলেও তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলে ধরে নিতে হবে।

এই মতবাদ অনুসারে মানুষের আল্লাহ প্রদত্ত যৌনাঙ্গ দিয়ে লিঙ্গ নির্ধারিত হয় না। বরং লিঙ্গ একটি সামাজিক ধারণা। কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ বলে মনে করে, তাহলে সে একজন পুরুষ। আবার কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী বলে মনে করে, তাহলে সে মূলত একজন নারী।

হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কি এক?

সম্প্রতি নিজেদের সুশীল দাবি করা কিছু মুক্তমনা দল ট্রান্সজেন্ডারবাদকে বৈধতা দেয়ার জন্য ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারের কথা বলে তাদেরকে হিজড়াদের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। প্রকৃতপক্ষে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কখনোই এক নয়। হিজড়া (intersex) এক অসহায় জাতি।

তারা প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ-প্রতিবন্ধী। যারা কোনোরূপ সার্জারি ছাড়াই এমন লিঙ্গ-প্রতিবন্ধীরূপে জন্মগ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের কোনো হাত নেই। হিজড়া হওয়ার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি ৫ হাজার জনে একজন হিজড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদ কোনো জন্মগত অসুস্থতা নয়। বরং স্বেচ্ছায় সার্জারি করে নিজের সুস্থ-সবল লিঙ্গ পরিবর্তন করে বা সার্জারি ছাড়া নিজের আইডেন্টিটি চেঞ্জ করার নাম হলো ট্রান্সজেন্ডারবাদ । সুতরাং একথা পরিস্কার যে, ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয়।

ইসলাম হিজড়াদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলেছে সেই ১৪শ’ বছর আগেই। ইসলাম হিজড়াদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি যথাযথভাবে প্রদান করার আদেশ দিয়েছে। এই বিশ্বজগত আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কোনো অঙ্গ দান করেন, যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন।

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ

তিনি সেই মহান সত্তা যিনি যেভাবে ইচ্ছা তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে আকৃতি দান করেন (সূরা-আলে ইমরান-০৬)

হিজড়ারাও মানুষ। অন্য প্রতিবন্ধীদের মত হিজড়াদের সাথে দয়া ও সহমর্মিতার আদেশ ইসলাম দিয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে সবধরনের অধিকার হিজড়ারাও পেতে পারে। তাই হিজড়াদের স্বীকৃত অধিকারের বুলিকে পুঁজি করে ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি আদায় করতে চাওয়া অযৌক্তিক। এটা জঘন্য এক মতবাদকে সর্বময় ছড়িয়ে দেয়ার কূটচাল ছাড়া আর কিছু নয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদ

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لقد خلقنا الإنسان في أحسن تقويم

অর্থ: আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে। (সূরা-ত্বীন, আয়াত ৪)

এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন সেটাই সর্বোত্তম। সবচেয়ে সুন্দর। মাধুর্যপূর্ণ। আল্লাহপ্রদত্ত সুস্থ স্বাভাবিক আকৃতি পরিবর্তন কখনোই সুন্দর হতে পারে না। উপকারী হতে পারে না। একথা শুধু মানুষের আকৃতি ও শারীরিক গঠণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন নয়, বরং এই জগতে প্রতিটি জিনিসই তার ন্যাচারাল ও আল্লাহপ্রদত্ত আকৃতিতে সুন্দর। অতি সুন্দর করতে গিয়ে মানুষের হস্তক্ষেপ পতিত হলেই বস্তু তার আপন সৌন্দর্য হারায়।

অতএব ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ কখনোই মানবতার জন্য কল্যাণকর নয়। এটা আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সৃষ্টিকে বিকৃত ও নষ্ট করার শামিল। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তার সৃষ্ট আকৃতি বিকৃত করাকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন ।

কোরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন-

ولآ مرنهم فليغيرن خلق الله

অর্থ: (শয়তান বলছে) আমি অবশ্যই তাদেরকে (মানুষদেরকে) আদেশ করব ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করবে। (সূরা নিসা, আয়াত ১১৯)

এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহর দেয়া সুস্থ সবল লিঙ্গ পরিবর্তন ও বিকৃত করা নিঃসন্দেহে একটি শয়তানি কাজ।

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যাক্তি শয়তানকে বন্ধু বানায় সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়। (সূরা নিসা- আয়াত: ১১৯)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীরের আকৃতি পরিবর্তন ও বিকৃত করার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি ব্যক্ত করেছেন।

হাদীসে আছে

لعن رسول الله صلى الله عليه و سلم

الرجل يلبس لبسة المرأة والمرأة تلبس

لبسة الرجل

অর্থ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ পুরুষের উপর লা’নত করেছেন যে নারীর ন্যায় পোশাক পরে এবং লা’নত করেছেন ঐ নারীর উপর যে পুরুষের ন্যায় পোশাক পরে। (আহমদ- ৮৩০৯)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত বাণীটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নারী-পুরুষের বাহ্যিক সাদৃশ্যও হারাম এবং নিষিদ্ধ । তাহলে পুরোদস্তুর একটা অঙ্গহানি করে নারী পুরুষ হতে চেষ্টা করা এবং পুরুষ নারী হতে চেষ্টা করা বা মনে মনে এসব চিন্তা করা বা ভাবা কতটা ভয়াবহ ও জঘন্য, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এমন ঘৃণ্য কাজ দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় এবং অধঃপতন ছাড়া আর কিছু নয়। ট্রান্স মতবাদ শুধু কেবল দেশ ও জাতির জন্যই ভয়াবহ নয় বরং এটি কোরআন ও হাদীসের সাথে সরাসরি বিদ্রোহের শামিল।

ট্রান্সজেন্ডারবাদ ব্যাক্তি জীবনে আনে ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়

ট্রান্সজেন্ডাররা নিজেদেরকে শারীরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ দাবি করলেও তারা মারাত্মক মানসিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। গবেষনায় দেখা যায় যে, সাধারণ মানুষের তুলনায় ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে আত্মহত্যার আশংকা ২২ গুণ বেশি। (সূত্র – কালবেলা: ১৯ ডিসেম্বর,২০২৩)

বৃটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এক জরিপে প্রকাশ করে, আমেরিকার ৫০% এরও বেশি ট্রান্সজেন্ডার নারী-পুরুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। (গার্ডিয়ান: ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২)

ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের শুধু আত্মহত্যার ঝুঁকিই নয় বরং তারা স্বাস্থ্যগতভাবেও হয় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। একটা সুস্থ- সবল দেহে অস্ত্রোপচার করার ফলে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পতিত হয়।

ডা. মারসি বোয়ার্স সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় স্বাস্থ্যগতভাবে খুবই আশংকাজনক। যাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা একান্ত জরুরি।

European journal of Endocrinology নামক বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত তথ্যানুসারে ট্রান্সজেন্ডার নারীদের মধ্যে ৯৫% এর বেশি নারীর হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া তাদের প্রবল ডায়বেটিসেরও সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রান্সজেন্ডারদের এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ২৬ থেকে ৩০ গুণ বেশি। তাছাড়া তাদের মাঝে মাদকাসক্তি, নিজে নিজের ক্ষতি করা (self-harm), ডিপ্রেশন ও উদ্বিগ্নতার প্রবণতা বেশি থাকে।

লিঙ্গ প্রতিস্থাপন ও নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটি চেঞ্জ করা যেকোনো মানুষের ব্যাক্তি জীবনে এক বড় সিদ্ধান্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাবই ব্যাক্তি জীবনে পড়ে। চারপাশের সামাজিক ও মানসিক চাপ এবং আল্লাহর চিরাচরিত নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান একজন ট্রান্স নারী- পুরুষের জীবনকে চরম দুর্বিষহ করে তোলে। এমনই একজন হলেন ক্রিস বেক। যিনি প্রথম প্রকাশ্য ট্রান্সজেন্ডার। তিনি জানান, লিঙ্গ পরিবর্তন ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভূল। তিনি বলেন, গত দশ বছরে আমার সাথে যা ঘটেছে তা আমার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। আমি নিজেই আমার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছি। (নিউইয়র্ক পোস্ট- ২০২২, ডিসেম্বর-১১)


Like it? Share with your friends!

0 Comments