মধ্যবিত্তের দেশ ভাবনা


বাংলাদেশের স্ট্রিট ইকোনোমির একটা প্যাটার্ন আছে। এর প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আনইমাজিনেবল সাইজ। মাসে ২০/৫০/৮০ হাজারের স্যালারি ড্র করা মিডল ক্লাসের আইডিয়াই নাই এই ইকোনোমির সাইজ সম্পর্কে।

যেকোনো একটা এলাকা ধরেন। ফর এক্সাম্পল, গুলিস্তান মাজারকে সেন্টারে রেখে ৫০০ মিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকেন। একদিকে বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া মার্কেট, একদিকে নবাবপুর কাপ্তানবাজার আর নবাবপুর ইলেকট্রিক মার্কেট, এক দিকে স্টেডিয়াম, এক দিকে জিপিও পার হয়ে পল্টন মোড়, একদিকে বায়তুল মোকাররম এবং স্টেডিয়াম, আরেকদিকে সদর ঘাটের রুটে প্রায় বংশাল মোড় পর্যন্ত। এই বৃত্তে অর্গানাইজড বিজনের সংখ্যাটা বেশ অনেক তবে আমার আলাপ অন্য জায়গাতে।

কম করে হলেও ৫ হাজার আন অর্গানাইজড বিজনেজ এনটিটি এই জায়গাতে ব্যবসা করে যাদের কারো কোনো ট্রেড লাইসেন্স নাই, ফিক্সড দোকান নাই। ফুটপাতে, রাস্তার উপরে, ফ্লাইওভারের নিচে, মার্কেটের বারান্দায়, স্টেডিয়ামের বাইরের চত্বরে যেখানে জায়গা পেয়েছে বসে গেছে চট, ছালা, পিভিসি প্লাস্টিকের ব্যানার বিছিয়ে। জাপানিজ সামুরাই, চা স্টল, রেপ্লিকা রোলেক্স ঘড়ি, ফ্যাশনেবল আন্ডারগার্মেন্টস, জোকের তেল, লেটেস্ট মডেল স্নিকার, ভাতের হোটেল, টিশার্ট, বেবি ফুড, ইম্পোর্টেড ফ্রুটস, ছাতা সেলাইয়ের মিস্ত্রি এহেন জিনিস নাই পাবেন না।

এই হকারেরা ডেইলি পয়সা দেয়। পয়সা খায় মূলত দুইটা গোষ্ঠী। একদিকে পুলিশ এবং অন্যদিকে পলিটিকাল পার্টি ও অন্যান্য। কোথাও কোথাও পুলিশ আর বাকিদের ক্লিয়ার সীমানা আছে। কোথাও কোথাও % হিসাব করে মেশানো। পুলিশের একদম ক্লকওয়াইজ সিস্টেম মেইনটেইন করে চলে। নিজস্ব অর্ডার অব প্রিসিডেন্স মেইনটেইন করে কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত একেবারে সিস্টেমেটিক অর্ডারে ভাগের টাকা পেয়ে যায় ফলে গ্যাঞ্জাম কম বা নাই বললেই চলে। গ্যাঞ্জাম পলিটিকাল অংশে।

লেটস ডু এ সিম্পল ম্যাথ। গুইলিস্তানের আশেপাশে ডেইলি প্রতিটা টঙ, ছাপড়া থেকে ৩০০ টাকা উঠায়। আন্দাজে বললাম। বছর দুই আগে আমার এলাকার সবজির ভ্যানের রেইট রিশিডিউল করেছিল পুলিশ। ১৫০ টাকার রেইট এক লাফে ২৫০ করেছিল। ভ্যানওয়ালারা নাকি ২০০ তে বহু দরাদরি করেছে। কিন্তু পুলিশ ভাইবোনদেরও তো সংসার নিয়ে বাচতে হবে নাকি? পচ্চুর ছাত্রলীগ করেও অনেকেরেই টাকা দিতে হয়েছে। কারো চাকরির জন্য, কারো পোস্টিংয়ের জন্য। ফলে টানা ১ সপ্তাহ ভ্যান বসে নাই কিন্তু পুলিশ রেইট কমায় নাই। হাইলি ইফিশিয়েন্ট উপায়ে তারা নেগোশইয়েট করে ২৫০ টাকাতেই রেইট ফিক্স করেছ নিজেদের পাওনা আদায় করেছে। । অফিস ফেরত মানুষের প্রভূত ভ্যাজাল হয়েছিল ৭ দিন। রীতিমতো সাংসারিক গ্যাঞ্জাম।

গুলিস্তানের রেইট আজিমপুরের থেকে কম হবে না। ফলে ৩০০ ধরে নিলাম। হিসাবের সুবিধায় কিছু মার্জিন অব এরর কনসিডার করে ৪০০০ দোকান ধরলাম। ৩০০*৪০০০= ডেইলি ১২ লাখ।
মাসে ৩ কোটি ৬০ লাখ। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, মালামাল পরিবনহ, অবৈধ ইলেকট্রিক লাইন, মদ/গাজা/জুয়া থেকে শুরু করে গুলিস্তানের সব চাঁদাবাজি একসাথে করা গেলে আমার ধারণা মাসে ১০০ কোটিও ছাড়িয়ে যাবে এই ৫০০ মিটারের বৃত্তের মাঝেই।

মাঝেমধ্যে ফুটপাত দখলের অভিযোগে উচ্ছেদ করলেও এনজিও, মানবাধিকার কর্মীদের হাউকাউ, এই ছিন্নমূল মানুষেরা কোথায় যাবে? এদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে উচ্ছেদ করা অন্যায়।
আবার ধরেন কেউ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে, দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করবে, দোকানের এডভান্স, ইয়ারলি রিনিউয়াল ফি, ট্যাক্স, ভ্যাট সব মিলিয়ে একটা ফরমাল বিজনেস ভেঞ্চারের যে ওভারহেড, তাতে যেই মার্জিনে পণ্য বিক্রি করতে হয়, যেই দাম আসে, এই হকার ভাইয়ের ওভারহেড সেই তুলনায় একেবারেই মিনিমাম। এবং তাদের মার্কেটিং কস্ট জিরো। কাস্টমার একুইজিশন কস্ট জিরো। ফলে একই প্রোডাক্ট হকার মার্কেটে পাওয়া যায় অনেক কম দামে। তাতে কাস্টোমারও খুশি।

কাস্টমার খুশি, দোকানদার খুশি, পুলিশ খুশি, এনজিও ভাইবোনেরা খুশি, চান্দাবাজ খুশি। এই খুশির মেলায় প্র্যাকটিকালি আরো অনেক কারণে স্ট্রিট হকার বা ফুটপাতের ভাইদের উঠানো সম্ভব হয় নাই আজ অব্দি। আর আনটিল পুলিশ নিজে তার ভাগা নেওয়া বন্ধ করতেছে, এই স্ট্রিট ইকোনোমি বন্ধ করার স্টেপ নেওয়ার মতো মোরাল পজিশন এই ফোর্সের নাই। পুলিশও ভাগা নেওয়া বন্ধ করবে না রাধাও নাচবে না।

এখন এই গুলিস্তান তো শুধু গুলিস্তানে না, সদরঘাটে, নিউমার্কেটে, মোহাম্মদপুরে, টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে, মিটফোর্ডে, বংশালে, ধানমণ্ডিতে, গুলশানে, গাজিপুর চৌরাস্তায়, যাত্রাবাড়িতে। মতিঝিলে… সবখানে।

পুলিশ, চাদা নিয়ন্ত্রক মাসলম্যানের দল, রাজনৈতিক দল এই তিনটা স্টেকহোল্ডার একত্রে এসে মিলে যায় একটা ইকুলিব্রিয়াম পয়েন্টে। তাতে মাসলম্যানদের দরকার একটা পলিটিকাল পার্টির কান্ধে সওয়ার হয়ে নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজির লাইসেন্সের। এই লাইসেন্স পাবে সবচেয়ে বড় মাসলওয়ালার। কারো মাসল দুর্বল হইলে আরেকজন রিপ্লেইস করবে ভায়োলেন্ট প্রসেসে। এই ভায়োলেন্সটা হয়ে আসছে আরবান মিডল ক্লাসে চোখের আড়ালে। এখন সোশ্যাল মিডিয়া হাইপার একটিভ হওয়াতে একটা পর্দা সরে গেছে জাস্ট। এতদিন আমাদের দেখতে হয় নাই, এখন হইতেছে।

গত ১৫ বছরে এই সিস্টেমটা ব্যরিস্টার তাপস, হাজি সেলিম, বেনজির, শামীম ওসমানরা খুব ভালোমতো কন্ট্রোল করায় পাবলিকলি আসে নাই অনেক কিছু। ঈসমাইল সম্রাটের মতো দুয়েকজন ধরা খেয়ে গেছে, পিরামিডের উপরের দিকের বাকি সবাই ক্লকওয়াইজ নিজের ভাগা নিয়ে অলরেডি দেশের বাইরে। ঝামেলা হইছে স্ট্রিট সোলজারদের। এরা তো খাইসলত পাল্টাইতে পারবে না। ফলে এখন এদের দরকার একটা শেল্টার। এই মুহূর্তে ভালো শেল্টার হইল বিএনপি, এনসিপি, জামাত-শিবির।

যেহেতু এন্টি আওয়ামী এবং এন্টি হাসিনা ও এন্টি শেখের পট্টি সেন্টিমেন্ট বাদে আর কোনো পয়েন্টেই বিএনপি, জামাত, এনসিপি এবং ইন্টেরিম একমত না ফলে এই স্ট্রিট সোলজারদের দৌরাত্ন থাকবে। ইন্টেরিমের উপদেষ্টাদের অনেকেই ক্ষমতার গদির আরাম, গরম ও মজা উপর্যুপরি ভোগ এবং উপভোগ করা শুরু করেছেন। তারা ইন্টেরিম দীর্ঘায়িত করতে যতটা আগ্রহী, ল অ্যান্ড অর্ডারে আগ্রহ ততটাই কম। এই স্ট্রিট সোলজারদের খুনাখুনিতে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার চান্সে অনেকেই বেশ আনন্দিত বলেই বোধ হচ্ছে।

এই স্ট্রিট ইকোনোমি জারি রেখে চান্দাবাজি ঠেকানো যাবে বইলা যারা বিশ্বাস করে, তাদেরকে আমার পাগল বা শিশুর মতো নির্মল, ইনোসেন্ট লাগে। যেন ১৬ বছর বয়সের আমি।

এর মাঝে একটা বড় আফসোস এইদেশে ভাইরাল না হইলে বিচার পাওয়া যায় না। জাস্টিস, ন্যায়, ইনসাফের মতো একটা ভারি শব্দগুলারে আমরা স্রেফ পাঞ্চলাইন বানায়া দিছি। আফসোস।


Like it? Share with your friends!

0 Comments