সমাজের প্রতিটি স্তরে আজ যেন এক অজানা অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুভূতির যে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা কেবল ব্যক্তিগত নয়—এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সমাজব্যবস্থার ওপর। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। কেউ কাউকে মান্য করছে না, কেউ কারো নির্দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ইসলামের আলোকে পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও নৈতিক চেতনা জাগ্রত করা।
সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও তার ফলাফল বর্তমান সমাজে দেখা যাচ্ছে—
সন্তানেরা পিতা-মাতার কথা শুনছে না, বরং তাদের সঙ্গে তর্ক করছে, এমনকি গালিগালাজ বা সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
ধর্মীয় অনুশাসনকে পিছনে ফেলে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে তরুণ প্রজন্ম নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
ইন্টারনেটভিত্তিক অশ্লীল কনটেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অশ্লীল ব্যবহার এবং মিডিয়ার অপসংস্কৃতি তরুণদের চরিত্র বিনষ্ট করছে।
পারিবারিক বন্ধন দিন দিন দুর্বল হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন কিংবা বাবা-মায়ের সম্পর্কেও অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে।
এই অবস্থাকে অনেকে ‘নৈতিক বিপর্যয়’ বলেই আখ্যা দিচ্ছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক দায়িত্ব ও নৈতিকতা
ইসলামে পারিবারিক সম্পর্ক ও নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় প্রত্যেক সদস্যের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত রয়েছে।
➤ পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন—তুমি কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি বার্ধক্যে পৌঁছে যান, তবে তাদের ‘উফ্’ বলো না এবং ধমক দিও না। তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো।”(সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ২৩)
এই আয়াত আমাদের শেখায়, পিতা-মাতার সঙ্গে আচরণ শুধু দায়িত্ব নয়, বরং ইবাদতের অংশ।
➤ সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব:
অন্যদিকে, পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানদের শুধু ভরণ-পোষণ নয় বরং তাদেরকে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা। রাসুল (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
এটি নির্দেশ করে, সন্তান যদি নৈতিক অবক্ষয়ের পথে চলে যায়, তবে পিতা-মাতাও তার জবাবদিহির মধ্যে পড়ে যাবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।”(সূরা তাহরীম, আয়াত ৬)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, সন্তানদের শুধু দুনিয়াবী প্রয়োজন নয়, বরং নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া পিতা-মাতার কর্তব্য। সন্তানদের শৈশব থেকেই কুরআন-হাদীস, আদব, শালীনতা ও উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
ধর্মীয় অনুশাসন না মানার সামাজিক পরিণতি:
যখন ব্যক্তি ধর্মীয় অনুশাসন বিস্মৃত হয়, তখন তার জীবন হয় দিকভ্রান্ত। ইসলাম ছাড়া জীবনের নৈতিক দিকনির্দেশনা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলাফল—
অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি: চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি ভয়াবহ অপরাধ সমাজে বেড়েই চলছে।
পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা: সন্তানদের অবাধ্যতা ও বাবা-মায়ের দায়িত্বহীনতা পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙে দিচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অবাধ্যতা
আত্মহত্যা ও মাদকাসক্তি: মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তরুণ সমাজ নেশা ও আত্মহননের দিকে ঝুঁকছে।
নৈতিক ও সামাজিক ভাঙন: ধর্ম ও শালীনতার অভাবে সম্মান, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও দায়িত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে।
পরকালীন শাস্তির সতর্কবার্তা
ইসলামে বলা হয়েছে, যারা পিতা-মাতার অবাধ্য, যারা সমাজে অশান্তি ও অশ্লীলতা ছড়ায়, তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।
“যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অবাধ্য হবে, জান্নাত তার জন্য হারাম।”(তিরমিযী)
এছাড়া রাসুল (সা.) বলেন:
“আমার উম্মতের মধ্য থেকে এক দলকে আমি কিয়ামতের দিন আগুনে দগ্ধ হতে দেখবো—কারণ তারা ছিল অশ্লীলতাকারী, অবাধ্য সন্তান ও সমাজ বিনষ্টকারী।”
উত্তরণের উপায়: ইসলামের আলোকে করণীয়
বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পেতে ইসলামের নির্দেশিত কিছু করণীয়:
ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা:
পারিবারিকভাবে কুরআন-হাদীস, নামাজ, রোজা, হালাল-হারাম সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
সন্তানের নৈতিক গঠন:
শৈশব থেকে সন্তানকে আল্লাহভীতি, দয়াশীলতা ও দায়িত্ববোধ শেখাতে হবে। পারিবারিক বন্ধনকে গুরুত্ব দেওয়া
পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন:
পিতা-মাতা যেন সন্তানের প্রতি উদাসীন না হন। তাদের চরিত্র গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:
মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে অশ্লীলতা প্রতিরোধে আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা প্রয়োজন।
দোয়া, তাওবা ও আত্মশুদ্ধি:
ব্যক্তি ও সমাজকে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। নিজের পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে, নেক আমলের পথে এগোতে হবে।
সমাজের এই ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় ও পারিবারিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের ইসলামের আলোকে জীবন গঠন করতে হবে। পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ককে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। এখনই সময়—নিজেকে ও সমাজকে ফিরিয়ে আনার, নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাবো এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপ।
0 Comments