বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে প্রথম আলো দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রভাবশালী নাম। পাঠকসংখ্যা, প্রচারক্ষমতা ও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে এই পত্রিকাটি শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু সচেতন পাঠক লক্ষ্য করছেন, প্রথম আলোর সংবাদ উপস্থাপন ও সম্পাদকীয় নীতিতে এক ধরনের দ্বিচারিতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে—বিশেষত যখন বিষয়টি নারীর অধিকার ও ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত।
নারীর অধিকার রক্ষার কথা বলা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ইসলামও নারীর সম্মান, নিরাপত্তা, উত্তরাধিকার, শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু প্রথম আলো যখন “নারীর অধিকার” শিরোনামে প্রতিবেদন বা মতামত প্রকাশ করে, তখন প্রায়ই দেখা যায় তারা ইসলামের মৌলিক বিধানকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হেয় করে।
নারীর অধিকার—তাদের চোখে শুধু পশ্চিমা ধাঁচে
প্রথম আলো প্রায়ই “নারীর অধিকার” শিরোনামে বড় বড় রিপোর্ট ছাপে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা অধিকার বলতে বোঝে কেবল পশ্চিমা লিবারেল মডেল, যেখানে ইসলামি মূল্যবোধের কোনো স্থান নেই।
প্রথম আলোর হিজাববিরোধী দ্বিচারিতা: প্রমাণ ও বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো নিজেকে “অগ্রগতির পক্ষে” দাবি করলেও তাদের সংবাদ ও কলামে বারবার এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে যা মুসলিম নারীর পোশাক ও ইসলামি জীবনযাপনকে পরোক্ষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রমাণ ১: মিসরে বৈষম্যের শিকার হিজাব পরা নারীরা
শিরোনাম: “মিসরে বৈষম্যের শিকার হিজাব পরা নারীরা” (২৭ আগস্ট ২০২২, ১৪: ১৩)
লিংক: https://www.prothomalo.com/world/africa/zquplsi7jq
বিশ্লেষণ: প্রতিবেদনটি মূলত মিসরের প্রেক্ষাপট নিয়ে হলেও প্রথম আলো যেভাবে হিজাবকে উপস্থাপন করেছে, তাতে মনে হয় হিজাব নিজেই বৈষম্যের কারণ। অথচ আসল বৈষম্য তৈরি করছে ধর্মবিদ্বেষী সমাজ—কিন্তু পত্রিকার ভাষা সেটিকে নারীর অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে ফ্রেম করেছে।
প্রমাণ ২: ভারতে হিজাব বিতর্ক
শিরোনাম: “ভারতে হিজাব–বিতর্কের পেছনের কারণ কী”
(১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮: ২৩)
বিশ্লেষণ: কর্ণাটকের কলেজে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে ক্লাসে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। প্রথম আলো একে কেবল রাজনৈতিক বিতর্ক হিসেবে তুলে ধরেছে, কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখায়নি। এখানে দ্বিচারিতা হলো—যেখানে পশ্চিমে ধর্মীয় পোশাক মানাকে “কনস্টিটিউশনাল রাইট” বলা হয়, সেখানে মুসলিম সমাজে একে “বিতর্ক” হিসেবে ব্র্যান্ড করা হয়।
প্রমাণ ৩: মুসলিম নারীদের পোশাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ
শিরোনাম: “মুসলিম নারীদের পোশাকেই কেন সরকারি নিয়ন্ত্রণ” (০৬ অক্টোবর ২০২৩, ২২: ০০)
লিংক: https://www.prothomalo.com/opinion/column/1c2yagr9lv?utm_source=chatgpt.com
বিশ্লেষণ: কলামটিতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশে হিজাব ও নিকাব নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। প্রথম আলো এখানে মূল সমস্যাটিকে ধর্মীয় বিদ্বেষ না বলে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে যে, হিজাব রাষ্ট্রীয় সেক্যুলারিজমের জন্য সমস্যা। অথচ বাস্তবতা হলো—হিজাব ইসলামি পরিচয় রক্ষা করে, সেটিকে আইন দিয়ে দমন করাই প্রকৃত বৈষম্য।
শিরোনাম: “৫৪ নাগরিকের বিবৃতি: বাংলাদেশ ব্যাংকের নারী কর্মকর্তাদের পোশাক নিয়ে নির্দেশনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি” (২৫ জুলাই ২০২৫, ২০: ১৩)
লিংক: https://www.prothomalo.com/bangladesh/a8le63lsgm
বিশ্লেষণ
১. স্বাধীনতা বনাম শালীনতার দ্বন্দ্ব
- একটি প্রতিষ্ঠানের ড্রেস কোড থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। ব্যাংক, করপোরেট বা আদালত—সবখানেই পোশাকের নির্দিষ্ট নীতি থাকে।
- কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যখন নারীদের পোশাকে শালীনতার কথা বলল, তখনই এটি “নারীর অধিকার হরণ” হিসেবে আখ্যায়িত হলো।
২. প্রথম আলোর ফ্রেমিং
- প্রতিবেদনের ভাষা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সংবাদটি আসলে ৫৪ নাগরিকের বিবৃতিকে হাইলাইট করে প্রকাশিত হয়েছে।
- এতে বোঝা যায়, প্রথম আলো নিজের সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংবাদটি এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাই মূল অপরাধ।
- অথচ সংবাদে বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে শালীন পোশাকের প্রয়োজনীয়তা, সাংবিধানিক অধিকার বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়নি।
৩. নারীর অধিকার আড়ালে ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঘাত
- বাস্তবে এই ধরনের নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য—কর্মক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও শালীনতা বজায় রাখা।
- ইসলামও শালীন পোশাকের কথা বলেছে।
- কিন্তু সংবাদটি ও নাগরিকদের বিবৃতি এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যেন “শালীন পোশাকের দাবি = নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।”
- অর্থাৎ নারীর অধিকার রক্ষার নামে ইসলামি শালীনতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
৪. সামাজিক প্রভাব
- এই ধরনের সংবাদ সমাজে বিভাজন তৈরি করে—একপক্ষ মনে করে নারীর স্বাধীনতা মানে পোশাকে কোনো বিধিনিষেধ না থাকা, আরেকপক্ষ মনে করে শালীনতা ইসলাম ও সংস্কৃতির অংশ।
- ফলে নারীর অধিকার নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা বাধাগ্রস্ত হয়, বরং ধর্ম ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব বাড়ে।
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রয়োজন
সাংবাদিকতার মূল নীতি হলো সত্য, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা। কিন্তু যখন সংবাদ মাধ্যম বাছাই করে ধর্মকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে, তখন তা নৈতিক সাংবাদিকতার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম আলো যদি সত্যিই নারীর অধিকার রক্ষায় আন্তরিক হয়, তবে তাদের উচিত—
- ইসলামের নারীবান্ধব দিকগুলোও সমান গুরুত্ব দেওয়া।
- মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের যুক্তি তুলে ধরা।
- ধর্মীয় মূল্যবোধকে হেয় না করে সংস্কৃতির ভিন্নতাকে সম্মান করা।
আমাদের করণীয়
- পাঠকের উচিত সংবাদ যাচাই করে পড়া, অন্ধভাবে প্রথম আলো বা অন্য যেকোনো গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর না করা।
- বিজ্ঞাপনদাতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত পক্ষপাতমূলক গণমাধ্যমকে বয়কট করা।
- পাঠকের প্রতিক্রিয়া ও গণআন্দোলনের মাধ্যমে এই দ্বিচারিতা বন্ধের দাবি তোলা।
প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের সকল সংবাদমাধ্যমের উচিত নিজেদের নীতি ও অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা। নারীর অধিকার রক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার আড়ালে ধর্মকে আক্রমণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। নৈতিক সাংবাদিকতা কেবল জনপ্রিয়তা বা পাঠকসংখ্যার জন্য নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর মাধ্যম হওয়া উচিত।
0 Comments