সাম্প্রতিক যে বিষয়টি গোটা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে সেটি হলো ধর্ষণ। যেখানে শিশু থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছে না। আর ধর্ষকদের অধিকাংশের বয়স বিশ থেকে পয়ত্রিশের কোঠায়। এক কথায় বলা চলে, আমাদের দেশের কিছু তরুণ ধর্ষণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের খবরগুলো ক্রমাগতই লোমহর্ষক হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছিল। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলেছে, ২০১৯ সালে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে,
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় ৩৪ হাজার ৪৭০টি মামলা করা হয়েছে। | |
২০১৯ | ৬১১৪ টি |
২০২০ | ৭১৯৪ টি |
২০২১ | ৬৯৮৬ টি |
২০২২ | ৭০১২ টি |
২০২৩ | ৬২৩২ টি |
২০২৪ | মার্চ মাস পর্যন্ত ১০৩২ টি |
প্রশ্ন হলো, ২০১৯ সালে কেন ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছিল? সেই বৃদ্ধি কেন অব্যাহত ছিল একাধারে ছয় বছর? কেন প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ বা দিনে গড়ে ১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল (পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী)? এই ধারাবাহিকতা থেকে আছিয়ার ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় আছে? হাজারো ধর্ষণের ঘটনার ভিড়ে অল্প কিছু ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
- তোলপাড় সৃষ্টিকারী সেই ঘটনাগুলোর কি মীমাংসা হয়েছিল?
- অপরাধীরা কি পেয়েছিল চূড়ান্ত শাস্তি?
- ভিকটিম নারী শিশুরা কি ন্যায়বিচার পেয়েছিল?
২০২২ সালের নারী, শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে ৯৭ শতাংশ মামলায় কোন সাজা মেলেনি, ৪১ শতাংশ বিচারের আগেই অব্যাহতি পায়, ৫৫ শতাংশ পায় বেকসুর খালাস। বিচারে অপরাধীদের যদি সাজাই না মেলে তাহলে ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার দায় আইন আদালতকেই নিতে হবে। বিচার পেতে যদি ৭-৮ বছর কেটে যায়, তাহলে বিচারের প্রতি আস্থাহীনতাই আসবে। এই আস্থাহীনতায় অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে চলছে। ফলে ধর্ষকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ১
আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের যে দেশীয় আইন রয়েছে তা ধর্ষণ রোধে যথাসাধ্য নহে। এর মধ্যে আইনেরই আবার ফাঁক-ফোকর রয়েছে যার ফলে ধর্ষণের বিচার সঠিক ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যামান আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে আমরা এটা অনুরোধ করতে চাই প্রায় অধিকাংশ মানুষ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর এবং আল্লাহর দেওয়া আইন বাস্তবায়নের।
দ্রুত এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের যেসব দায়িত্ব রয়েছে ইসলামের দৃষ্টিতে তা তুলে ধরা হলো-
- ধর্ষণ রোধে ব্যক্তির দায়িত্ব শালীন পোশাক
আমাদের বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাকেই শালীনতা আনতে হবে। পুরুষ নারীর বেশে কিংবা নারী পুরুষের পোশাক পরিধান করবে না। এখানে ইসলাম ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নষ্ট করেনি বরং অশ্লীলতাকে নিষেধ করেছে।
সমাজের নারী-পুরুষ আজ পাতলা ও আঁটোসাঁটো পোশাকের মহড়া দিচ্ছে। যার সয়লাব তরুণ-তরুণীদের অন্যায়ে উদ্বুদ্ধ করছে। অথচ জারির ইবন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, অনেক মানুষ পোশাক পরিধান করা অবস্থায় উলঙ্গ থাকেন, অর্থাৎ তার পোশাক পাতলা বা স্বচ্ছ হওয়ায় ‘সতর’ আবৃত হয় না (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ৫/১৩৬)।
- নিম্নগামী দৃষ্টি
নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই চোখ অবনমিত রাখার বিধান পবিত্র কুরআনে দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে নবি) মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে, আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। (সূরা আন-নুর : ৩০-৩১)।
- প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে করান
আমাদের সমাজ আজ বেকারত্বের অজুহাতে বিয়েকে কঠিন করে ফেলেছে আর অলিখিত বিধানে যিনা, পরকীয়া এমনকি ধর্ষণকেও বৈধতা দিয়েছে। বাবা-মায়ের উচিত, সন্তান প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হলে সামর্থ্য থাকলে তাকে বিয়ে দেওয়া। বিয়ে শিক্ষা বা চাকরির জন্য অন্তরায় হয় না বরং নিরাপদ হয়।
বিয়ে প্রথা কঠিন হওয়ায় সমাজের তরুণ-তরুণীরা আজ অবৈধ ভালোবাসায় জড়াচ্ছে, সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, সম্পর্কের নামে দৈহিক মেলামেশা অবাধ হচ্ছে। অথচ, সঠিক সময়ে বিয়ে হলে সমস্যাগুলো সমাধান সহজ হয়ে যেত।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়েহীন তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও-তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। (সূরা আন-নুর : ৩২)।
- ব্যভিচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি
বিয়েবহির্ভূত উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক সম্পর্ক হচ্ছে জেনা, বিবাহিত কিন্তু পরকীয়ার মাধ্যমে দৈহিক সম্পর্ক হচ্ছে ব্যভিচার আর বল প্রয়োগ কিংবা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যে দৈহিক সম্পর্ক হচ্ছে সেটিই ধর্ষণ। আমাদের সমাজে আজ সবই মহামারি আকার ধারণ করছে। এ থেকে বাঁচতে আল-কুরআনের ছায়াতলে আসতে হবে। বলা হয়েছে, তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (আল-ইসরা : ৩২)।
- রাষ্ট্রের দায়িত্ব ধর্ষকের বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি
ধর্ষণে তিনটি অপরাধ ফুটে ওঠে। যথা-
ক. ব্যভিচার, খ. সম্ভ্রম লুণ্ঠন, গ. বল প্রয়োগ।
সুতরাং এ অভিযোগে অভিযুক্তদের তিনটি ধারাতেই দৃষ্টান্তমূলক বিচারের সুযোগ থাকতে হবে। প্রকৃত ধর্ষকের পক্ষে উকিল নিযুক্ত থাকার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আইন করা সমীচীন হবে। অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে সাজা থেকে মুক্তি দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্ষকের কোনো দল থাকতে পারে না।
তাই, ধর্ষক যে দল, ধর্ম বা মতেরই হোক না কেন ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মেলার পর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষকের পক্ষে কোনো পদস্থ ব্যক্তির সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচিত করতে হবে। আর বল প্রয়োগে ধর্ষণকারীর বিচার পবিত্র কুরআন থেকে কোনো একটি চয়ন করা যথার্থ হবে মনে করছি।
এরশাদ হয়েছে-যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদগুলো বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (আল-মায়িদাহ : ৩৩)।
- নৈতিক শিক্ষার গুরুত্বারোপ বৃদ্ধি
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চরিত্র অবক্ষয় রোধে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান ও এর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। সম্ভব হলে বিজ্ঞান বিষয়ের মতো নৈতিক শিক্ষায়ও ২০-২৫ নম্বরের ব্যবহারিক নম্বর থাকতে পারে। তবেই আমাদের তরুণ সমাজ ধর্ষণের ভয়াবহতা ও এর শাস্তি সম্পর্কে জানবে এবং নারীদের সম্মান দিতে শিখবে। তদ্রূপ তরুণীরাও তাদের শ্রেষ্ঠ যে মর্যাদা ইসলাম দিয়েছে তা রক্ষায় সচেষ্ট হবে। এ কারণেই রাসূল (সা.) বলেছেন, (ধর্মীয় আবশ্যিক) জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ (সুনানু ইবনে মাজাহ : ২২৪)।
- ভিকটিমের জেরা হবে নমনীয় ভাষায়
আমাদের আইনে এখনো বলা আছে যে, ‘একজন যদি ধর্ষণের অভিযোগ করেন, তাহলে বিচারের সময় তার চরিত্র নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করা যাবে’। ফলে আদালতে দাঁড়ানো ধর্ষিতা মা-বোন অভিযুক্তের আইনজীবী দ্বারা এমন জেরার মুখে পড়েন যা তাদের মর্যাদাকে আরও ভূলণ্ঠিত করে। বিচারক উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেও আইন যেহেতু এ ধরনের প্রশ্নের অনুমতি দিয়েছে তাই তিনিও নিরুপায় হন।
মানুষের মস্তিষ্ক পরিবেশ দ্বারাই প্রভাবিত হয়, তাই আমাদের পরিবেশ বদলাতে হবে। আসুন আমরা সবাই আমাদের বেশভূষার বিষয়ে সচেতন ও শালীন হই। পিতা-মাতা সন্তানের বিয়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময় নির্বাচন করি। ব্যভিচারে লিপ্ত সমাজকে বজ্রকণ্ঠে প্রতিহত করি এবং দেশের আইন কার্যকর করতে সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করি।
পরিশেষে এ অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধে এবং নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় দ্রুত কঠোর আইনে বিচারকার্য বাস্তবায়নই সরকারের প্রতি আপামর জনগণের আকুতি।
সোর্সঃ
১- দৈনিক আমাদের সময়
২- দৈনিক যুগান্তর
0 Comments