সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত একটি বিষয় হলো, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি বা বাঙালি জাতির পিতা কে? যদিও এ বিষয়টা নিয়ে এর আগেও অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। সম্প্রতি এমন প্রশ্নের উত্থান হয় গত বুধবার (১৬-১০-২৪) বাংলাদেশ সচিবালয়ে -তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে।
বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মনে করে কি না এই সরকার? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অবশ্যই না।’
তাহলে তো আমাদের কোনো জাতির পিতা থাকবে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই ভূখণ্ডের লড়াইয়ের ইতিহাসে বহু মানুষের অবদান রয়েছে। আমাদের ইতিহাস কিন্তু কেবল ’৫২-তেই শুরু হয়নি, আমাদের ব্রিটিশবিরোধী লড়াই আছে, ’৪৭ ও ’৭১-এর লড়াই আছে, ’৯০ ও ’২৪ আছে। আমাদের অনেক ফাউন্ডিং ফাদারস রয়েছে। তাদের লড়াইয়ের ফলে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।’
আমরা অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ মানুষ (প্রায় ৬২-৬৫%) বর্তমান সরকারের কথা ও অভিপ্রায়ের সাথে একমত। হয়তোবা আওয়ামী লীগের অনুসারী ছাড়া (অনেকেই এটা মানতে নারাজ কিন্তু বলতে পারে না) কেউ ই এই উপাধি মানতে চাননা বা নারাজ। তার এই উপাধিতে অধিকাংশ ইতিহাসবিদের ও বিশেষজ্ঞদেরও দ্বিমত রয়েছে। আর যেহেতু দেশের বেশিরভাগ অংশই এটা মেনে নেন না তাহলে এই উপাধি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো কেন?
সমস্যাটা হল, যখনই কোন কিছু জাতীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, একক নেতৃত্বে বা ক্ষমতায়, তখনই তা প্রশ্নবোধক হয়ে উঠে। রাষ্ট্রীয় ভাবে জনগণের কোন নিরঙ্কুশ মেন্ডেট নাই যে বঙ্গ বন্ধুকে জাতীর পিতা হিসাবে গ্রহণ করার, এমন কোন নজির কোন কালেই নেওয়া হয় নাই এবং সম্ভবও না, সমস্ত জনগণের একজনও যদি বলে সে এই প্রস্তাব মানে না, সরকারের বা অন্য জনগণের কোন ক্ষমতা নাই তাকে বাধ্য করার, আর মনে রাখা উচিত পৃথিবীতে কেউই কিন্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে নাই, তাই মানুষ হিসাবে আমরা সবাই কম বেশী অপরাধী, এবং সে জন্য আমরা কোন নিরঙ্কুশ মেন্ডেট দিতে পারি না যে সেই ব্যক্তি আমদের জন্য আদর্শ বা অনুকরণীয়।
এর উত্তর হতে পারে, তারা দেশটাকে নিজের পিতার মনে করেছিল বা যিনি দিয়েছেন তিনি হয়তোবা আরো কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বা মানুষের Subconscious Mind এ তাকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা বা আরো অন্যান্য কারণ রয়েছে।
আরেকটি বিষয় আমাদের জেনে যাক, জাতির পিতা বলতে আমরা আসলে কি বুঝি- যিনি স্বাধীন দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার অগ্রনায়ক এবং যিনি তার জীবনকে দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক দেশেই Father of the Nation দৃশ্যমান বা প্রতীয়মান।
কিন্তু এখানেই আমাদের থামতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে, এই কথা বা তত্ত্বগুলো কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া বা বলা হয়েছে বা কারা বলেছেন। আমরা যেটা জানি, যিনি ইসলামের পতাকা হাতে অগ্রণী সেনা, ইসলাম, মহান রবের ও আখিরাতের জন্য নিরলস কঠোরভাবে কাজ করে গেছেন এবং আল্লাহর প্রিয়, অনুগত ও নেককার বান্দা। মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ইব্রাহিম আ: কে ঘোষণা করেছেন।
- পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
قوله تعالي ملة ابيكم ابراهيم .هو سمكم المسلمين‘
তোমাদের জাতির পিতা ইবরাহীম, তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।’ ( সুরা হাজ্জ-৭৮)।
এই আয়াত থেকেই প্রমাণিত তিনি মুসলিম জাতির পিতা। যেহেটু পুরো সৃষ্টির মালিক আল্লাহ্ তা’লা তাই তিনিই বলতে পারেন আসলে আমাদের জাতীর পিতা হিসাবে কাকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত এবং তাই তিনি ইব্রাহীম (আঃ) কে আমাদের জাতীর পিতা হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমাদের তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মানতে হবে। এটা ইমানেরও দাবী বটে। শেষ গন্তব্য যদি ভাষা বা দেশ ভিত্তিক না হয় তবে বিপদ আসন্ন।
দেশীয় হিসাবে বা ভাষা ভিত্তিক কোন জাতীর পিতা মনোনয়ন করা কোন ক্রমেই সঠিক সিধান্ত হতে পারে না তাই আজ এই প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। দেশের গণ্ডি ও ভাষার ব্যাপকতা অনেক জটিল এবং আপেক্ষিকও বটে। স্থান, কাল পাত্র সব সময়ই পরিবর্তনশীল।
এখন অনেকেরই প্রশ্ন জাগতে পারে, তারা তো বলে বা বলতে চায় যে বঙ্গবন্ধু তো বাঙালি জাতির পিতা। এখন আমাদের কথা হলো বাঙালি কারা -এরা কি ধর্ম পরিচয়হীন মানুষ, তাদের কি কোনো ideology নেই, নাকি তারা রাজনীতির ধর্ম মানে বা মানব ধর্মকে মানে (যেখানে পৃথিবীটাই টিকে আছে ধর্মের মাধ্যমে বা কারণে)।
না, তাদেরও অবশ্যই ধর্মীয় পরিচয় আছে- আমরা অধিকাংশই মুসলিম (৯০%)। এতগুলো মানুষের আদর্শকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এই নাম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও এটা মেনে নিতে চান না।
আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষরা চাই এই পরিবর্তন করা হোক। এখানে কিছু কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও অর্জনে তার ভূমিকা অনন্য ও অনস্বীকার্য। আমরা এটা বলতে পারি -তাকে অন্য কোনো পদবীতে ভূষিত করলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না যদি না সেটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। যদিও তার সর্বজন গৃহীত উপাধি রয়েছে -বঙ্গবন্ধু, মহা রাষ্ট্রনায়ক ইত্যাদি।
0 Comments