এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণে মরণদশা


দেশে প্রাচীন কাবুলিওয়ালাদের নয়া সংস্করণ ‘এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার বেড়াজালে আটকে গেছে গ্রামগঞ্জের নারী-পুরুষ। গরিবী হটাও আর স্বাবলম্বী নামে বিদেশী টাকায় শত শত এনজিও মাকড়সার জালের মতো সারাদেশে ক্ষুদ্রঋণের জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। এ ঋণের জালে আটকে গেছে লাখ লাখ অসহায় নারী-পুরুষ।

  • এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেশীয় এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৫৫৮। এর মধ্যে অধিকাংশেরই আছে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে আছে মাল্টিপারপাস কোম্পানি; আছে নানা সমিতিও। সূত্র জানিয়েছে, দেশের ৩ কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে

নারী স্বাবলম্বী এবং আত্ম কর্মসংস্থানের নামে এনজিওগুলো গ্রামের মানুষের মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে। চড়া সূদে সে ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির যোগান দিতে গিয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ছে ঋণ গ্রহীতারা।

স্বাবলম্বী হওয়া তো দূরের কথা ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে ভিটা-মাটি, ঘটি-বাটি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী বিক্রি করতে হচ্ছে। ঋণের কিস্তির যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা এবং কিডনী বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি বংশ পরম্পরায় ক্ষুদ্রঋণের সূদের ঘানি টানতে হচ্ছে। ঋণের কিস্তি নিয়ে বিরোধে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অবক্ষয় এবং ঘর-সংসার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

  1. সম্প্রতি বগুড়ার ধনুটের গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের যমুনার চরের কয়েকজন ঋণ গ্রহীতা জানান, কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। তারপরও কিস্তির জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। ফলে এনজিও’র মাঠকর্মীদের দেখলেই তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হন।
  2. জয়পুরহাট জেলার কালাই গ্রামের আখতার আলম নামের এক ব্যক্তি এনজিও’র ঋণের কিস্তি নিয়মিত দিতে পারেনি। অতঃপর একপর্যায়ে ঋণের দায় মেটাতে কিডনী বিক্রি করেছে। কালাই গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা মুকাররম হোসাইনও ক্ষুদ্রঋণের চক্করে পড়ে কিডনী বিক্রি করেছে।
  3. রংপুরের কাউনিয়ার আছিয়া খাতুন জানান, তার মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন আশির দশকে। মা মারা যাওয়ার পর ঋণের কিস্তি সে চালিয়েছিল। এখন নিজে কাজকর্ম করতে পারেন না। এখন সে কিস্তি চালায় তার ছেলে।
  4. ওমর আলী নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগী পালন, কুটিরশিল্প, রবিশস্য ফলানো সবকিছুতেই এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে ঋণ দেয়া হয়। সে ঋণের সূদ নেয়া হয় শতকরা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
  5. এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ যুবকের আত্মহত্যা: মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মানিকনগর গ্রামের হিরোক মন্ডল (৩৬) পেশায় রাজমিস্ত্রি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালাতে গিয়ে একের পর এক বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিতেন। ডজনেরও বেশি এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জর্জরিত হয়ে পড়েন। এনজিওদের চাপে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) আত্মহত্যা করেন তিনি। হিরোক মন্ডল মানিকনগর গ্রামের উৎপল মন্ডল ওরফে নতু মন্ডলের ছেলে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরিবী হটানোর নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে কোন কোন এনজিও শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত সূদ আদায় করে থাকে। উত্তরাঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে এমন এনজিওর সন্ধানও পাওয়া গেছে যারা শতভাগও সূদ আদায় করছে। তাদের আদায়ের পদ্ধতিও অদ্ভুত।

এনজিওর ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই ঋণের দায়ে অতিষ্ঠ। তারা এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু এনজিওগুলির কৌশলী তৎপরতায় তারা কোনভাবেই এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

  • উল্লেখ্য, ৭০-৮০-এর দশকে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মানবদরদীরা এদেশের অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং অক্সফাম, ডানিডা, খ্রিস্টান সোসাইটিসহ কয়েকটি এনজিও’র মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহায়তা দিতে থাকে। কিন্তু এভাবে চাহিদা না মেটায় পরবর্তীতে তা বেসরকারী পর্যায়ে এনজিও’র মাধ্যমে পরিচালিত হ’তে শুরু করে। শর্ত ছিল তারা অসহায় গরীবদের না লাভ-না লোকসানের ভিত্তিতে ঋণ ও সহায়তা দিবে। তখন থেকেই ধনী দেশগুলোর সরকার ও বেসরকারী সাহায্য প্রতিষ্ঠান তাদেরকে অকাতরে অর্থ দিয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দশকে ব্র্যাকে সব মিলিয়ে ৪৫ কোটি পাউন্ডের মতো সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। অন্যান্য সংস্থা এবং দেশের অনুদানের কথা বাদ’ই দিলাম। ঠান্ডা মাথায় একবার চিন্তা করে দেখবেন; ২ হাজার ৫৫৮ টি এনজিও কি পরিমাণ বৈদেশিক সহযোগীতার অর্জন করেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের গরীব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে এনজিওগুলো এখন দাদন ব্যবসায় নেমে পড়েছে। একদিকে তারা গরীবের জন্য বিদেশ থেকে আনা অর্থে দামি গাড়ি-বাড়ী, অট্টালিকার মালিক হচ্ছে; অন্যদিকে গরীবদের ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে ফেলে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। অথচ ক্ষুদ্রঋণের জালে আটকে অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছে গ্রামের দরিদ্র মানুষ।

  • এদিকে সরকার এসব বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার। স্বাধীনতার পর থেকে যে সরকারই ক্ষমতাসীন হয়েছেন, কারোরই এ বিষয়ে সামান্য কোন মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায়নি।

সূত্রঃ

  • প্রতিদিনের সংবাদ
  • মাসিক আত-তাহরীক

Like it? Share with your friends!

0 Comments