খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও আমদানিতে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ। চাল উৎপাদনে টানা পাঁচ বছর বিশ্বে তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক পরিসংখ্যান বর্ষপঞ্জি ২০২৩-এ এসব তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।
উৎপাদিত এসব পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন। এরমধ্যে মানুষের খাদ্য বাবদ হয়েছে ২ কোটি ৫২ লাখ টন। এই হিসাবে, সেবছর উৎপাদনে উদ্বৃত্ত ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ টন। এমনকী পশুখাদ্য উৎপাদন, বীজ, চালকলে হওয়া অপচয়, গুদামে নষ্ট হওয়া ইত্যাদিসহ ফসল সংগ্রহ ও সংগ্রহ পরবর্তী সময়ের ক্ষতি বাদ দেওয়ার পরেও– উদ্বৃত্ত ছিল ৩০ লাখ টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত হলেও– ওই বছরেই বাংলাদেশ প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন আরও বেড়ে পৌঁছে যায় প্রায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে। যা দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত বাড়ানোরই সহায়ক হয়। কিন্তু, তবু বাংলাদেশকে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে।
উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকলেও, বাংলাদেশ এখনো কেন চাল আমদানি করছে?
এর প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা প্রয়োজন। আমরা এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে যতগুলো কারণ জানতে পেরেছি তারমধ্যে অন্যতম কারণ গুলো হলো-
১। নন-হিউম্যান কনজাম্পশন।
২। মোটা চালকে চিকন করা (মিনিকেট/ নাজিরশাইল নামে পরিচিত)
দেশে প্রায় এক হাজার প্রকারের ধান চাষ হয়। এর মধ্যে মিনিকেট এবং নাজিরশাইল নামের কোনো ধান বাংলাদেশে চাষ হয় না। অথচ বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালে সয়লাব।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিআর ২৮, বিআর ২৯, কল্যাণী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, আইআর-৫০, জাম্বু ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। অর্থাৎ মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করছেন মিল-মালিকরা। মিনিকেট চাল তৈরিতে মিল-মালিকরা প্রথমে মোটা জাতের ধান কিনে সেগুলো চাল করে। তারা প্রথমে ধানের বাইরের খসখসে খোসাটিকে আলাদা করে। এর ওজন ধানের প্রায় ২০ শতাংশ। পরে সেই চাল আরও কয়েক দফা সেদ্ধ করা হয়। এটি করা হয় মূলত চালকে চিমড়া বা শক্ত করার জন্য। কেননা শক্ত না হলে ছাঁটাইয়ের সময় চাল ভেঙে যাবে। আর এটা করতেই অনুমোদিত ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ছাঁটাই করছে মিল-মালিকরা। তারা মূলত অধিক মুনাফার লোভেই এটা করছেন।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশে বছরে চার কোটি টন ধান ক্রাসিং হয়। মিল মালিকদের হিসেবে, চাল চিকন করতে গিয়ে ৪-৫ শতাংশ উধাও হয়ে যায়। সে হিসেবে বছরে ১৬ লাখ টন চাল নষ্ট হয়ে যায়। যার বর্তমান বাজার মূল্য (গড়ে কেজিতে ৪৫ ধরে) প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। যা প্রত্যেক বছর অপচয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুসারে মাথাপিছু ১৫২ কেজি চালের প্রয়োজনীয়তা ধরে নিয়ে আমাদের বার্ষিক চালের চাহিদা নিরূপণ করা হয়। সেই অনুপাতে যেই পরিমাণ চাল নষ্ট তা দিয়ে কমপক্ষে ১ কোটি মানুষকে ১ বছর খাওয়ানো যাবে।
এ কাজ বন্ধ হলে বিদেশ থেকে চাল আমদানিও করতে হতো না। আমরা আরো রপ্তানি করে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারতাম, যা আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক সহায়ক হতো ।
এখানে আরেকটি সূক্ষ বিষয় হলো যে, মিল–মালিকরা ২০-২৫ শতাংশ চাল ছাঁটাই করেও তারা মুনাফা অর্জন করছে, তাহলে দেখা যাচ্ছে এদিকে ৭ হাজার কোটি পাশাপাশি তাদের মুনাফা এই দুই মিলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, যা অপূরণীয় ।
এছাড়াও যে প্রক্রিয়ায় মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে কম দামের চাল বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
মোটা চাল ছেঁটে চিকন করার ফলে চালের পুষ্টি উপাদানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মিলমালিকরা মিনিকেট চাল চকচকে করার জন্য ইউরিয়া সারসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশান।
- চালে কী উপাদান থাকে : প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) চালে শর্করা থাকে ৮০ গ্রাম, চিনি ০.১২ গ্রাম, ফাইবার ১.৩ মিলিগ্রাম, স্নেহ পদার্থ ০.৬৬ গ্রাম, প্রোটিন ৭.১৩ গ্রাম। ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে- থায়ামিন (বি১) ০.০৭০১ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.০১৪৯ মিলিগ্রাম, ন্যায়াসেন (বি৪) ১.৬২ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ১.০১৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন (বি৬) ০.১৬৪ মিলিগ্রাম। ধাতুর মধ্যে রয়েছে- ক্যালসিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, লোহা ০.৮০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ১.০৮৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১১৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১১৫ মিলিগ্রাম, দস্তা ১.০৯ মিলিগ্রাম। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে পানি ১১.৬১ গ্রাম।
- অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ে চালের যেসব গুণ নষ্ট হয় :
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের ফলে মিনিকেট নামে এই চালে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, প্রোটিন, আঁশ- এসবের কিছুই থাকে না। শুধু থাকে কার্বোহাইড্রেড। এই চালের ভাতে অভ্যস্তদের লাইফস্টাইল ডিজিজ হওয়ার ঝুঁকি প্রবল। পলিশ করার কারণে মিনিকেট চালে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১.১৭ শতাংশ বেড়ে যায়। শর্করার পরিমাণ বাড়লে গ্লাইসিমিক ইনডেক্স বেড়ে যায়।
চাল থেকে প্রায় অর্ধেক প্রোটিন বা আমিষ পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে আমিষ থাকে প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশের মতো। কিন্তু কলে ছেঁটে চিকন করার কারণে ১ থেকে ২ শতাংশ প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ফ্যাট বা অয়েল কমে যাওয়া। অয়েল কমে যায় ৬২ শতাংশ, ক্রুড ফাইবার কমে ৪০ শতাংশ এবং অ্যাশ কমে ১১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভিটামিন বি-১, বি-৬ প্রায় ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।
মিনিকেট চালের ক্ষতিকর দিক :
মিনিকেট চালের স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিকের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর এম আখতারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, পলিশ করার কারণে মিনিকেট চালে শর্করার পরিমাণটা আরও বেড়ে যায়। এটা বেড়ে যাওয়া মানে আমরা যখন মিনিকেট চালের ভাত খাব তখন ওই উপাদানটা গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে দ্রুত রক্তে মিশে যাচ্ছে। ফলে সেটা ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ এই চাল খেয়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। আর যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা আরও বাড়ছে। এ ছাড়া ক্যানসার, অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া- এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং কম বয়সেই বার্ধক্য চলে আসে এই চাল খেয়ে।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ—
সরকারের ভূমিকা :
আমরা অর্থাৎ জনগণ এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সরকার যদি কোনো কাজ চালু বা বন্ধ করার সদিচ্ছা করে যদিও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকে এবং সরকারের সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রয়োজন তবুও সরকারের ভূমিকা সেই কাজকে কমপক্ষে ৬০-৭০% সম্পাদন করা সম্ভব, ইনশাআল্লাহ।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে সরকার যে পদক্ষেপ নিতে পারে –
১. “চাল পলিশ আইন-২০২৪” যথাযথ ও দ্রুততম সময়ে প্রয়োগ করা।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন আগামী আমন মৌসুম থেকেই এই আইন কার্যকর করা হবে।
(০২ মে ২০২৪, Dhaka Post)
২. ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের বা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত অভিযান বা তদারকি চলমান থাকা।
৩. অপরাধী মিল মালিক কে অতি দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। এবং সেটা মিডিয়ার মাধ্যমে ঢালাওভাবে প্রচার করা।
জনগণের ভূমিকা :
যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে আসে তা প্রতিরোধে আমাদের স্বতপ্রবৃত্ত ভাবে সরকার কে সহোযোগিতা করা আমাদের একান্ত দায়িত্ব।
১. আমাদের উচিৎ হবে কৃষি বিষয়ক সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী – পূর্বের ন্যায় মোটা চাল খেতে অভ্যস্ত হওয়া।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও গবেষণাটির দলনেতা নাজমা শাহীন বলেন- ভোক্তাদেরও চকচকে চাল কেনার অভ্যাস দূর করতে হবে।
সূত্র (অনলাইন)ঃ
১। সময়ের আলো
২। প্রথম আলো
৩। বাংলা ট্রিবিউন
৪। দৈনিক ইত্তেফাক
৫। দৈনিক কালেরকন্ঠ
0 Comments