পাঠ্যবইয়ে অনিয়ম “সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা” – আপনার মূল্যবান মত দিন।


নতুন বছরের পাঠ্যবইয়ের দিকে লক্ষ করলে একটি বাংলা প্রবাদ মনে পড়ে যায় সেটি হলো-

সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিব কোথা!”

বিষয়টা হলো এমন যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি বা দাখিল পর্যন্ত সেটা হোক বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যম বইগুলোর এমনভাবে সাজানো বা উপস্থাপন করা হয়েছে যে ইসলামবিদ্বেষ, পর্দার অবমাননা, অবাধ মেলামেশা, ট্রান্সজেন্ডারবাদ, সমকামিতা, ইতিহাস বিকৃতি ও ইসলামশিক্ষা বইয়ে ভিন্নধর্মের বিষয়াদি ও প্রতিকৃতি দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিস্ফুটিত ।

আরেকটি বিষয়…….

আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মভীরু। এই জনপদের প্রতিটি  মুসলমান ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করেন। এখানকার সবাই হয়তো প্র্যাক্টিসিং মুসলমান নন; কিন্তু কুরআন কিংবা রাসূল সা: অথবা ইসলামের কোনো বিধানের অবমাননা হলে এই মানুষগুলোই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন, প্রতিবাদে নেমে আসেন রাজপথে। এটি তাদের সুপ্ত ঈমান ও ইসলামপ্রীতির পরিচয়। যে দেশের সাধারণ জনগণের রক্তকণিকায় ইসলামপ্রেম বহমান, প্রত্যহ ভোরে যাদের ঘুম ভাঙে আজানের সুমধুর ধ্বনিতে, সেই দেশের কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য প্রতিফলিত হবে এটিই ছিল স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ঘটনা। অথচ অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনার বিষয় হলো- নতুন বছরের পাঠ্যবইয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।

এ দেশের হিন্দু-মুসলিম সব অভিজাত নারী পর্দা ও শালীনতার ঐতিহ্য বহন করে চলেন আপন শরীরে। এ দেশের কোনো বধূ কিংবা মায়ের মুখ কল্পনা করতে গেলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘোমটা টানা নারীর মুখচ্ছবি। এটিই এ দেশের নারীর চিরায়ত পরিচয়।

অথচ এই দেশের কোনো শ্রেণির বইয়ে এই বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে নি। আমরা যদি শুরুতে দাখিলের ৫ম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বইগুলো দেখি তাহলে দেখবো যে, কোনো বোরকা পরিহিত ছবি নেই, আর হিজাব পরিহিত ২ বা ৩টি কিন্তু মুসলিম ও বাঙালি সংস্কৃতি পরিপন্থি শত শত রয়েছে ।

উদাহরণস্বরুপ….

  • ষষ্ঠ শ্রেণি দাখিলের ইংরেজি বইয়ে প্রায় ৪৫ টি মেয়েদের ছবি রয়েছে তার মধ্যে শুধুমাত্র ১ টি হিজাব পরিহিত তবুও পরিপূর্ণ নয় ।
  • ৬ষ্ঠ শ্রেণি দাখিলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ১২ নাম্বার পৃষ্ঠায় ব্যয়াম শিখাতে গিয়ে তারা এক নিকৃষ্ট ছবি এনেছেন, আপনারা চাইলে দেখে নিতে পারেন ।
  • ৫ম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে fashion শব্দ শিখাতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ছবি এনেছেন ।

যা এ দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়কে রক্তাক্ত ও ক্ষুব্ধ করেছে কারণ মানুষজন তাদের সন্তানকে মাদরাসায় পাঠায় যাতে তারা অপসংস্কৃতি না শিখে বা গ্রহণ করে, কিন্তু ঐখানেও যদি এমন হয় তাহলে মানুষজন যাবে কোথায়?

আমরা নারীর শিক্ষা ও প্রগতির বিরোধী নই। পর্দা পালনের পরও যে নারীরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কাণ্ডারি হতে পারেন, তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চার পাশে আছে। তবু কেন পর্দাকেই অগ্রগতির অন্তরায় ভাবা হবে? আমাদের ধর্ম, সমাজ ও কৃষ্টিবিরোধী এই গল্পের বিকল্প অনুসন্ধানের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে সবিনয় অনুরোধ করছি।

এখানেই শেষ নয়।

  1. ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণির ইংলিশ ফর টু ডে বইয়ের প্রচ্ছদে ছিল টুপি ও হিজাব পরিহিত বালক-বালিকার ছবি। এ বছরের নতুন বইয়ে বালকের মাথা থেকে টুপি ও বালিকার মাথা থেকে হিজাব সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
  2. এছাড়াও ২য় পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরস্পর কথোপকথনের সময় সালাম বিনিময় ছিলো কিন্তু, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সালাম মুছে ফেলে সেখানে ‘গুড মর্নিং’ শব্দ দেয়া হয়েছিলো এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষেও তা অপরিবর্তীত রাখা হয়েছে। 
  3. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই এর ৩৯ পৃষ্ঠায় দেশিয় সংস্কৃতির নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ঢোল-তবলা উপস্থাপন করা হয়েছে। 
  4. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের নবমশ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠায় ইসলামের বিধান একাধিক বিবাহকে অন্ধকার প্রথা হিসেবে বলা হয়েছে।
  5. ৬ষ্ঠ শ্রেণির (স্কুল ও দাখিল মাদরাস) স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় ‘স্ট্যান্ডিং এলবো টু নী ক্রানসেজ’ নামক ব্যায়াম এর পদ্ধতি শিখাতে গিয়ে মেয়েদের ৩ টি দৃষ্টিকটু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যা অন্যান্য ধর্মতো বটেই ইসলাম ধর্মের শালীন পোশাক এর বিপরীত চিত্র প্রকাশ করেছে। সচেতন অভিভাবক কোনভাবেই এটা মেনে নিতে পারেননি।
  6. সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরিফার গল্প আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত বইয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দেও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
  7. বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মাধ্যমে সমকামিতার মতো রাষ্ট্র ও সভ্যতাবিরোধী অপকর্ম স্বাভাবিক ও সহজলভ্য হয়ে উঠবে, যা এই জনপদের হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য আক্ষরিক অর্থেই অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।

প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ইসলাম ও কৃষ্টিবিরোধী এ রকম অসংখ্য অনুষঙ্গ নতুন পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ঢোকানো হয়েছে। এ ঘটনায় প্রতিটি মুসলমান ব্যথিত ও রক্তাক্ত হয়েছে। এটি যে দুর্ঘটনাবশত আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়; বরং পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক ও ধর্মবিদ্বেষ থেকে সংঘটিত হয়েছে, বিকৃতির সংখ্যাধিক্যই তার প্রমাণ বহন করে।

প্রতিকার ও প্রস্তাবনা

১. পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের ব্যাপারে যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হোক।

২. পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনায় যোগ্য, অভিজ্ঞ, নীতিবান, ইসলামবিদ্বেষী নন এবং যারা আমজনতার ভাষা পড়তে পারেন, এমন বিচক্ষণ সংবেদনশীল মানুষকে নিয়োগ দেয়া হোক। পাশাপাশি সম্পাদনা প্যানেলে আলেমসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের খতিব, হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান অথবা তাদের পর্যায়ের কাউকে রাখা হোক।

৩. ইসলাম ও সব ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বহু বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও বিতর্কিত বিবর্তন মতবাদকে পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করা হোক কিংবা এটি একটি মত হিসেবে উল্লেখ করা হোক।

৪. দাড়ি-টুপি-পর্দাসহ যেকোনো ধর্মের ধর্মীয় অনুষঙ্গকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বিষয় পরিহার করা হোক।

৫. মুসলিম শাসনামলের শুধু নেতিবাচক দিক উল্লেখ না করে তাদের ইতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখ করা হোক।

৬. অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ব্যাপারে মুসলমানদের আন্দোলন ও অবদানের ইতিহাস তুলে ধরা হোক।

৭. বইয়ের প্রচ্ছদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হোক।

৮. সমকামিতাসহ দেশের আইনে নিষিদ্ধ এমন বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করা হোক।

৯. মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হোক। মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী অনুষঙ্গ ফিরিয়ে আনা হোক এবং বিশেষত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো মতবাদ ও বিষয় থেকে মাদরাসার পাঠ্যবইকে বিযুক্ত রাখা হোক।

১০. পাঠ্যবইয়ে দেশের সাধারণ জনগণের কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেয়া হোক। সাম্প্রাদায়িক শান্তি বিনষ্টকারী উসকানিমূলক বিষয় পরিহার করা হোক। পরিশেষে, এ দেশের শিক্ষাবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, বিজ্ঞ আলেম, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টরা নতুন প্রণীত পাঠ্যবই সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, তা গুরুত্বের সাথে দেখার এবং যাচাই-বাছাইপূর্বক সংস্কার করার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।


Like it? Share with your friends!

0 Comments